তোমারে চিনি না আমি/ মাহবুব মোর্শেদ/ প্রকাশক : আদর্শ/ ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮/ দাম : ৩৮০ টাকা
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭১ সালের বসন্তের তীব্র গরমের মধ্যে যেই দেশে এক
নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়, সেই বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান
দূষিত দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটিতে, ঢাকায়, সম্প্রতি একদিন
যখন অফিসমুখো সকালে মানুষ ছুটছে, তখন ধানমন্ডি লেকের পাশে নির্জনতার মধ্যে
বসে কাঁদছেন একজন। একজন অফিসযাত্রী কাঁদছেন। বাসার কাছের নিউজস্ট্যান্ড
থেকে দিনের সবকয়টা পত্রিকা কিনে নিয়ে এখানে ছুটে এসেছেন তিনি, কাগজগুলো
চারপাশে ছড়ায়ে দিনের বড় খবরটি পড়বার চেষ্টা করছেন। মৃতদেহের রক্তাক্ত ছবিটি
না হলেও সাদাকালো অস্পষ্ট ছবিটি তিনি চিনতে পারছেন। ‘খুব কাছের কেউ
বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলে কী ঘটে?’, মাথার মধ্যে প্রশ্ন তার। এই প্রশ্ন
মাহবুব মোর্শেদের উপন্যাস ‘তোমারে চিনি না আমি’র।
এই অফিসযাত্রীটির—রানা রহমানের—মাঝবয়সে এসে যিনি সম্প্রতি তার পেশাজীবন, ভালোবাসা, নন-কনফর্মিস্ট যৌনতা এবং ছাত্রজীবনের রাজনীতি-একটিভিজমের মধ্যে খুবই ক্লিশে অর্থে ‘সার্থকতা’ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন—তার কাছের লোক কেউ আছেন বলে দেখা যায় না। মা-বাবা, পরিবার তো নয়ই, উপন্যাসের যারা নায়ক; লুবনা, লুত্ফুননাহার, নুরুন্নাহার, মিলা, মিথিলা, রোজ, পপি ও নাজনীন—কেউ তার কাছের লোক নয়, হয়ে ওঠেনি। সংসার, শরীর আর প্রেমের মধ্যে ডুবে ডুবে একা একাই এতদূর চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু আজ এই অফিসমুখো সকালে টের পাওয়া গেল, ‘সরদার’ তার খুব কাছের লোক ছিলেন।
‘আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন, প্রেম আর যৌনতার ভিন্ন ও সম্পর্কহীন দুটো জিনিসকে আমরা কীভাবে অবশ্যসম্পর্কিত করে ফেললাম?’ এই প্রশ্ন রানাকে করতেন যেই সরদার। জগতের সব লোভ পাপ মায়া বাসনার স্পর্শ থেকে দূরের এক জীবন কাটাচ্ছিলেন বলে যিনি মনে করতেন, সেই সরদার। মহানন্দা নদীর তীর ধরে একটি জীবন কাটিয়ে দিতে চাইতেন যিনি, সেই সরদার। সরদার বিশ্বাস করতেন, রানা এই উপন্যাসের কাহিনিকে নিজের জীবনের কাহিনি বানাতে পারতেন, রানা পারতেন নিজের জীবনের প্রটাগনিস্ট হতে। ছাত্ররাজনীতির হৈচৈ ও রাস্তার আন্দোলন না করে বরং রানা লেখক হোক, জীবনের স্বপ্ন দেখাক এই জনপদের মানুষকে, সেইটে চাইতেন সরদার। রানা আজ অফিসে কেন, ধানমন্ডি লেকের এই নির্জনতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। বন্দুকযুদ্ধে সরদারের মৃত্যুর খবর পড়ার চেষ্টা করছেন রানা। সরদার হতে পারতেন এই উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট।
কিন্তু পুরুষের এই দেশে এই উপন্যাসের নায়ক বরং লুবনা, লুত্ফুননাহার, নুরুন্নাহার, মিলা, মিথিলা, রোজ, পপি ও নাজনীন। বিষয়সম্পত্তি অর্জনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে; সংস্কৃতিচর্চায়, রাজনীতিতে, ব্যবসায়, করপোরেট অফিসে যেদিকেই যদ্দুর যাওয়া হোক না কেন; শেষ পর্যন্ত সমাজের ‘নৈতিক জীবনে’ আটকে থাকতে হয় যাদের। নাজনীন যেমন বাস করে রানার প্রতিরাতের দুঃস্বপ্নের সাক্ষী হয়ে। তার স্বামী চান না, তাদের বাচ্চা কন্যাসন্তানটি বাবার দুঃস্বপ্নের কথা জানুক। ‘আমি চাই আমার মেয়ে ভীতু হবে না আমার মতো। ও ওর জীবনটা নিজের মতো করে সাজাবে, নিজের মতো চালিয়ে নেবে।’
‘আপনার কি মনে হয়, এ রকম সমাজে আমরা নিজের ইচ্ছামতো সৃজনশীল কাজ করতে পারি?’ এই প্রশ্নটি সরদারের জন্য বরাদ্দ ছিল রানার তরফে। আজ এই সকালে সরদারের নিহত হবার খবর পড়তে পড়তে ‘রাগে-ক্ষোভে বিস্ময়ে’ চিত্কার করতে ইচ্ছে করছে রানার। ততক্ষণে দুজন লোকের একটা জুটি এসে লেকের ধারেই বসল। নিজেদের মধ্যে ডুবে যাবার আগে তারা কিছুক্ষণের জন্য রানার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল।
ইত্তেফাক
এই অফিসযাত্রীটির—রানা রহমানের—মাঝবয়সে এসে যিনি সম্প্রতি তার পেশাজীবন, ভালোবাসা, নন-কনফর্মিস্ট যৌনতা এবং ছাত্রজীবনের রাজনীতি-একটিভিজমের মধ্যে খুবই ক্লিশে অর্থে ‘সার্থকতা’ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন—তার কাছের লোক কেউ আছেন বলে দেখা যায় না। মা-বাবা, পরিবার তো নয়ই, উপন্যাসের যারা নায়ক; লুবনা, লুত্ফুননাহার, নুরুন্নাহার, মিলা, মিথিলা, রোজ, পপি ও নাজনীন—কেউ তার কাছের লোক নয়, হয়ে ওঠেনি। সংসার, শরীর আর প্রেমের মধ্যে ডুবে ডুবে একা একাই এতদূর চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু আজ এই অফিসমুখো সকালে টের পাওয়া গেল, ‘সরদার’ তার খুব কাছের লোক ছিলেন।
‘আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন, প্রেম আর যৌনতার ভিন্ন ও সম্পর্কহীন দুটো জিনিসকে আমরা কীভাবে অবশ্যসম্পর্কিত করে ফেললাম?’ এই প্রশ্ন রানাকে করতেন যেই সরদার। জগতের সব লোভ পাপ মায়া বাসনার স্পর্শ থেকে দূরের এক জীবন কাটাচ্ছিলেন বলে যিনি মনে করতেন, সেই সরদার। মহানন্দা নদীর তীর ধরে একটি জীবন কাটিয়ে দিতে চাইতেন যিনি, সেই সরদার। সরদার বিশ্বাস করতেন, রানা এই উপন্যাসের কাহিনিকে নিজের জীবনের কাহিনি বানাতে পারতেন, রানা পারতেন নিজের জীবনের প্রটাগনিস্ট হতে। ছাত্ররাজনীতির হৈচৈ ও রাস্তার আন্দোলন না করে বরং রানা লেখক হোক, জীবনের স্বপ্ন দেখাক এই জনপদের মানুষকে, সেইটে চাইতেন সরদার। রানা আজ অফিসে কেন, ধানমন্ডি লেকের এই নির্জনতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। বন্দুকযুদ্ধে সরদারের মৃত্যুর খবর পড়ার চেষ্টা করছেন রানা। সরদার হতে পারতেন এই উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট।
কিন্তু পুরুষের এই দেশে এই উপন্যাসের নায়ক বরং লুবনা, লুত্ফুননাহার, নুরুন্নাহার, মিলা, মিথিলা, রোজ, পপি ও নাজনীন। বিষয়সম্পত্তি অর্জনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে; সংস্কৃতিচর্চায়, রাজনীতিতে, ব্যবসায়, করপোরেট অফিসে যেদিকেই যদ্দুর যাওয়া হোক না কেন; শেষ পর্যন্ত সমাজের ‘নৈতিক জীবনে’ আটকে থাকতে হয় যাদের। নাজনীন যেমন বাস করে রানার প্রতিরাতের দুঃস্বপ্নের সাক্ষী হয়ে। তার স্বামী চান না, তাদের বাচ্চা কন্যাসন্তানটি বাবার দুঃস্বপ্নের কথা জানুক। ‘আমি চাই আমার মেয়ে ভীতু হবে না আমার মতো। ও ওর জীবনটা নিজের মতো করে সাজাবে, নিজের মতো চালিয়ে নেবে।’
‘আপনার কি মনে হয়, এ রকম সমাজে আমরা নিজের ইচ্ছামতো সৃজনশীল কাজ করতে পারি?’ এই প্রশ্নটি সরদারের জন্য বরাদ্দ ছিল রানার তরফে। আজ এই সকালে সরদারের নিহত হবার খবর পড়তে পড়তে ‘রাগে-ক্ষোভে বিস্ময়ে’ চিত্কার করতে ইচ্ছে করছে রানার। ততক্ষণে দুজন লোকের একটা জুটি এসে লেকের ধারেই বসল। নিজেদের মধ্যে ডুবে যাবার আগে তারা কিছুক্ষণের জন্য রানার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল।
ইত্তেফাক
No comments:
Post a Comment