Friday, March 2, 2018

আড় ভাঙার উপন্যাস 'তোমারে চিনি না আমি' : সালাহ উদ্দিন শুভ্র


অনেক দিন পর একটানা কোনও উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। আগে যখন আমার উপন্যাস পড়ার খুব ঝোঁক ছিল, সেই যে স্কুলে থাকতে, তখন উপন্যাস পড়ে যেমন বুঁদ হয়ে থাকতাম। উপন্যাসের কথাগুলো, চরিত্ররা, সংলাপ সারাক্ষণ লেপ্টে থাকত আমার সঙ্গে। আমি বই না-হাতে মনে মনে সেই উপন্যাস নিয়ে ঘুরতাম। খালি মনে হতো কখন গিয়ে পড়ব উপন্যাসটা আবার, শেষে কী আছে, শেষটা কী আগেই পড়ে ফেলব? তাইলে তো সব মজা শেষ। অথবা তর্ক করতাম উপন্যাসে বলা থিওরির সঙ্গে, ঘটনার সঙ্গে, লজিকের সঙ্গে, ফিলসফির সঙ্গে- কিছু মানতাম, কিছু খারিজ করতাম। উপন্যাস পড়ার পর মনে হতো- আমার কিছুটা বয়স বেড়েছে, কিছু পরিবর্তন এসেছে স্বভাবে ও আচরণে। এমন একটা উত্তেজনা নিয়ে অনেক বছর পড়লাম মাহবুব মোর্শেদের নয়া উপন্যাস 'তোমারে চিনি না আমি'।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্র এক প্রবল আমি। তার নাম রানা। ঢাকায় একটা এনজিওতে তিনি চাকরি করেন। তার বউয়ের নাম নাজনীন, পরে একটা মেয়ে হয় তাদের, নাম নয়নতারা। রানা প্রচণ্ড অভিমানী, আন্তর্মুখী, গম্ভীর এক চরিত্র। সে মনেপ্রাণে চেয়েছিল কবি হবে অথবা বিপ্লব করবে। কিন্তু কিছুই তার করা হলো না। যেসব মেয়েদের সঙ্গে তার কবিতার, যৌনতার, বিপ্লবের, সমাজ পরিবর্তনের সম্পর্ক ছিল- তারাও তার সঙ্গে আর থাকল না। রানা এক বেতনভুক, গৃহগামী পুরুষে পরিণত হলো। কিন্তু তার ইচ্ছা আর ইতিহাসের চক্র থেকে সে বের হতে পারে না। অতীতের চরিত্রদের সঙ্গে তার যোগাযোগও ঘটে না, ভুলেও থাকতে পারে না।
উপন্যাসের বড় একটা বা বলতে গেলে পুরো অংশটাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে। এখানে রানার সঙ্গে গভীরতা বাড়ে অথবা পরিচয় ঘটে যাদের তারা হলেন সরদার, পপি, রোজ, মিলি, মিথিলা, দীপক, লুৎফুন্নাহার ইত্যাদি। এই লুৎফুন্নাহার রানার প্রথম শিহরণ নুরুন্নাহারের বোন। নুরুন্নাহারকে রানা ছোটবেলায় চুমু খেয়েছিলেন, কিন্তু তারপর হুট করে নুরুন্নাহারেরর বিয়ে হয়ে যায়। এই বিচ্ছেদ রানা মানতে পারে না, এটাও বুঝতে পারে না তার সঙ্গে নুরুন্নাহারের কী ছিল? প্রেম ছিল, না শরীর ছিল। ভালোবাসা ছিল, না কাম ছিল। 'তোমারে চিনি না আমি'- উপন্যাসটি ঘুরেছে-ফিরেছে প্রেম ও শরীরের সন্ধানে।
রানার জীবনে নুরুন্নাহারের পর মিলা ও মিথিলা আসে। রানার কাছে নারীরা শরীরবিনে আসে না, যৌনতা ছাড়া আসে না। এই যৌনতা, প্রেম, সমাজ, সংসার, নৈতিকতাকে জড়িয়ে যে ট্যাবু চলমান; তা ভাঙার, তাকে প্রশ্ন করার একটা প্রয়াস মাহবুব মোর্শেদের নতুন উপন্যাসটি। সরদার, যিনি পরে রানার সঙ্গে যুক্ত হন, তিনি অনেকটা গুরুর ভূমিকায় রানার সামনে আবির্ভূত হন। তার যুক্তি, বিশ্লেষণ, দূরদৃষ্টির মধ্য দিয়ে রানা বুঝতে শুরু করে নতুন অনেক কিছু। শরীর জাগা আর প্রেম জাগা দুটোকে ভিন্ন বিষয় হিসেবে দেখানোর নানা উপায় উপন্যাসটিতে আছে।
যৌনতাকে এত নিবিড়ভাবে, খোলামেলাভাবে, দ্বিধাহীনভাবে বাংলা উপন্যাসে এর আগে নিয়ে আসা হয়েছে কিনা- তা আমার অভিজ্ঞতায় নাই। এই তুলে ধরার সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের এখানে যৌনতাকেন্দ্রিক যে বিধিনিষধে রয়েছে, আড়ষ্টতা রয়েছে, অনেক সংস্কার রয়েছে সেগুলো ভাঙা জরুরি। কারণ এ-সংক্রান্ত অনেক অপরাধ ঘটে। তাছাড়া এখানকার উপন্যাসে যৌনতা যেন নাই মানুষের জীবনে, অথবা থাকলেও তা 'সাহিত্য' করার মধ্য দিয়ে অনেকটাই অযৌনভাবে উপস্থিত থাকে। শরীরে যে কামনা থাকে তা নীতি-নৈতিকতা দ্বারা এমনভাবে শৃঙ্খলিত যে লেখকরাও তার লেখায় আড়ষ্ট থাকেন, লিখবেন কী লিখবেন না এই দ্বিধায় থাকেন। মাহবুব মোর্শেদের 'তোমারে চিনি না আমি' উপন্যাসটি সেই আড় ভেঙে দিয়েছে।

এই উপন্যাস যিনি পড়বেন তার মধ্যে একটা ছাপ তৈরি হবে, চিন্তায় একটা পরিবর্তন আসবে, জীবন-যাপন অনেক হালকা হয়ে আসবে। আমাদের লেখকরা তাদের ঘাড়ে যে অনেক ভূত বয়ে নিয়ে লেখেন, এই উপন্যাসে তার দায় নাই। অনেকটা নির্ভার হয়ে, জীবনের সরল ও গোপন কথাগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন যারা তারা বুঝবেন, তাদের জীবনের একেবারে সাদামাটা ঘটনা, বাক্য, সংলাপগুলোও উপন্যাসে উঠে আসাটা কতটা তাদেরকে উপন্যাসের সঙ্গে একাত্ম করবে। কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ আবার সহজ হলেও অগভীর কিছু লেখেন নাই। তার উপন্যাসের পুরোটাই আধ্যাত্মিক ও গভীর দার্শনিক উপলব্ধিতে তৈরি। তার গদ্যের আঠায় মন মজে যায়, তার ঘটনার বিবরণ থেকে উঠে আসা সহজ হয় না। উঠে আসলেও রেণু রেণু জড়িয়ে থাকে।
নিজের জীবনে যা ঘটে নাই, কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে লেখার যে কসরত এখানে চলে, সেই ট্যাবুও ভেঙে গেছে এই উপন্যাসে। মিছিলের বিবরণ, গাঁজা খাওয়ার বিবরণ, স্থানের ও ঘুরে বোড়ানোর বিবরণ যদি খোলামেলাভাবে দেওয়া যায়, তাহলে সঙ্গমের বিবরণ কেন দেওয়া যাবে না- সেই প্রশ্নের উত্তরও মিলবে এখানে।
রানা এক প্রেমবঞ্চিত পুরুষ। মিলা ও দীপক তাদের প্রথম সঙ্গমের সময় যে একটা বিদ্যুতের দেখা পেয়েছিল, তারা ভেবেছিল নিজেদের একটা জুটি হিসেবে, সেই ছোঁয়া রানার জীবনে আসেনি। সে এমন বিদ্যুৎ পায়নি। কেন পায়নি? কারণটা ভিন্ন, উপন্যাসের টুইস্টটা এখানে। কারণ রানা এখানে সময়। আমাদের সময় প্রেমহীন, আমাদের সময় অনেকরকম শৃঙ্খলা, নৈতিকতায় আবদ্ধ- রানাও তাই। যে কারণে তার প্রেম হয় না। পরিবারের সঙ্গে তার বনিবনা নাই, কেন নাই তাও পরিষ্কার না। যেন রানা এমনই, অথবা সে নিখাঁদ, প্রেমময় সম্পর্ক চায় তাই এমন। সম্পদের সম্পর্ক নয়। মিলাও তো পরে আর সুখে থাকে নাই, সেও বলে শেষ পর্যন্ত কেউ সুখী হয় না। কবিতা যে লিখত রানা। কবিতায়ও যখন সমাধান পায় না তখন বিপ্লব করতে যায়। সেখানেও হতাশা। সরদারের সঙ্গে রানা অদ্ভূত সুন্দর সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, লালনের অনুসারীদের কাছে যায়, পদ্মার পাড়ে সবুজ, শ্যামল, সবজির মাচা ঘেরা পুরানা জমিদার বাড়িতে যায়, রোজের সঙ্গে শোয়- এতকিছু সরদারের সঙ্গে, কিন্তু সরদারের সব কথাও রানা শোনে না।
দৈনিক পদ্মায় কবিতা ছাপানোর সুবাদে সরদার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে রানার সঙ্গে দেখা করতে। তারপর তিনি, পপি ও রানা মিলে একটা লিটল ম্যাগ করতে চান, কিন্তু তাও হয় না। একে একে পপি আর রোজও চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে, আসে লুৎফুন্নাহার, নুরুন্নহারের বোন, তার দিকেও আকৃষ্ট হয় রানা। সরদারের ডেরায় যায় তাকে নিয়ে। বড়বোনের পর ছোটবোনের সঙ্গেও তার প্রেম হয়, শরীর জাগে। রানা নিরুপায়, কামকে সে আটকায় না। সরদার তাকে উস্কে দেয়। কিন্তু রানার যৌনতা, সরদারের যৌনতা অভব্যতা নয়। সেটা অজাচার নয়, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে, পরস্পররে ভালোলাগাকে তারা উপভোগ করেন। সমাজ যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এসব ক্ষেত্রে রানা তা ভেঙে দিয়েছেন।
যৌনতা আমাদের উপন্যাসে ফ্রয়েড তাড়িত হয়ে এলেও, মাহবুব মোর্শেদ ভিন্নি প্রস্তাবও উপস্থাপন করেছেন। কী সেই আলোচনা আরও বিষদ অন্যত্র করা যাবে।
পুরো উপন্যাসটি এখানে একটা কবিতার মতো, অনেক ভাবাবেগ, অনেক ভাবালুতায় পেয়ে বসবে পাঠককে। প্রকৃতির এমন অপরূপ বর্ণনা আছে যে মনে হবে আহা এমন জায়গায় কেন আমাদের যাওয়া হয় না। ঢাকা শহরের পাঠকদের বিশষত অনেক বন্দী মনে হবে নিজেদের। জীবনের মধ্য বয়সে এসে রানাও যেমন বন্দী। চাকরি করা আর ঘরে ফেরা ছাড়া তার কাজ নাই। অতীত যে গেছে একেবারেই গেছে তার জীবন থেকে। রানার কান্না আসে, দম বন্ধ হয়ে আসে, সংসারও করতে পারে না ঠিকমতো। তার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, না-হতে পারার যন্ত্রণায় আমাদের সময়টাই যেন রানা। তার মনে অসুখ। কী হওয়ার কথা ছিল অথচ কী হয়ে সে বসে আছে- সম্ভবনারহীত।
গ্লি এরা 

No comments:

Post a Comment