আমাদের প্রত্যেকেরই বড় হয়ে উঠার একটা গল্প আছে।
মাগরিবের নামাজ পরার জন্য পুকুর ঘাটে অজু করতে বসেছি। আমার পাশেই অজু করছেন আমাদের এক শিক্ষক। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'বড় হয়ে কার মতো হতে চাস?'
এর কিছুদিন আগেই আমি উপস্থিত রচনা লিখে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হয়েছিলাম। বিষয় ছিল, 'ছোটদের বঙ্গবন্ধু'! ফলে আমি আর সাতপাঁচ না ভেবে বলে দিলাম, 'বঙ্গবন্ধুর মতো হতে চাই।' স্যার আমার কানে-গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। আমি সামলাতে না পেরে পুকুরে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি আজও জানি না, আমার আপরাধটা কি ছিল?
আমরা জীবনের একেক সময় একেক কিছু হতে চাই।
ছোটবেলার ইচ্ছেগুলো একটু অন্যরকম। অদ্ভুত। কেউ আইসক্রিমওয়ালা, কেউ ট্রাক ড্রাইভার। কিন্তু একটু বড় হলে, যখন বুঝতে শিখি, তখন কিন্তু সত্যিই কিছু একটা হতে চাই। হতে পারি কি শেষমেশ? হওয়া কি এত সহজ? আবার একটা সময় আসে, তখন মনে হয় আর কিছুই হতে ইচ্ছে করে না।
রানা একটা এনজিওতে কাজ করে। স্ত্রী আর এক কন্যা নিয়ে সংসার। এনজিও'র ফান্ড পড়তির দিকে। ফলে কোনমতে হাফ স্যালারি দিয়ে সংসার চালায়। কাজ শেষে কোনমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে বাড়ি ফিরে। তারপর শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। কোনও সামাজিকতায় পাওয়া যায় না তাকে। কিন্তু রানাও ফেলে এসেছে টগবগে অতীত।
একটা মফস্বল শহরে বেড়ে উঠেছিল রানা। তারপর রাজশাহী বিশবিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স। ছোটবেলায় খালাতো বোনের সাথে প্রেম, চুমু, আদর। তারপর একদিন খালাতো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। রানা জানে না, ওটা প্রেম ছিল কীনা!
রানা বড় হতে থাকে। বিতর্ক, আবৃত্তির সাথে যুক্ত হয়। কবিতা পড়ে, লেখে। কবি হতে চায়। তার কবিতা পড়ে সরদার নামের এক রহস্যময় মানুষ তার সাথে দেখা করতে চলে আসে। রানার চিন্তার জগতের মোড় ঘুরে যায়। পরিচিত হতে থাকে নানারকম পাঠের সাথে। সরদার চায় রানা কবি হবে, লিখবে। ওদিকে বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় রানা, স্লোগান তোলে। নির্জনতাকে খুন করে রানা তাহলে নেতা হতে চায়? অনিয়ম দেখে তাহলে হাসফাঁস করে কেন?
রানার জীবনের নারীদের সাথে পরিচয় হয় আমাদের।
দীপকের প্রেমিকা মিলার শরীর দেখে লোভ জাগে। মিথিলার প্রেমে পড়ে; অথচ বলা হয়ে উঠেনা। ইউনিভারসিটির সবচেয়ে সুন্দরী; অথচ সিনিয়র রোজ'কে কবিতার জালে পটায়। রোজ একসময় পাশ করে চলে যায়, প্রেমও স্তিমিত হয়ে আসে। রোজে'র বন্ধু পপির সাথে জড়িয়ে যায় কয়েক মাসের জন্য। পপিরও চলে যাওয়ার সময় আসে। রানা'র জীবনে আসে লুৎফুননাহার, তার প্রথম প্রেম নুরুননাহারের ছোট বোন। রানার খালাতো বোন!
আমরা রানা'র জবানিতে, সরদারের মুখে, পপির মননে প্রেম এবং যৌনতার আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাই। ধর্মের কিছু অভ্যাস পালন না করাই যে নাস্তিক হয়ে যাওয়া নয়, সেই ব্যাখ্যাও আমরা পাই এই বইয়ে।
গতকাল মাহবুব মোর্শেদ এর লেখা 'তোমারে চিনি না আমি' পড়ার পর থেকে আমার ঘোর এখনো কাটেনি। এই বইয়ের গল্প, ভাষা আর অনবদ্য বর্ণনায় ডুবে বুঁদ হয়ে আছি। মনে হল, বহুদিন বাদে, কেউ আমার গল্প বললো, আমাদের গল্প বললো।
আমরাও এরকম লেখক হতে ছেয়েছিলাম, কেউ কবি, কেউ বিপ্লবী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামক এক অবিশ্বাস্য মুক্ত দুনিয়ার চৌকাঠ পেরিয়ে এসেছি। কিছু কি হতে পেরেছি আমরা? আমাদের বুকের ভেতরে ঘুমন্ত সেসব ইচ্ছের কথাগুলো কেউ যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিল। বললো, 'উঠ, এখনো কত কি করার বাকি!'
এই বইয়ের গদ্যের প্রশংসা কিভাবে করবো আমার জানা নাই। একবার মনে হয় জীবনানন্দ পড়ছি, আবার মনে হয়ে সৈয়দ শামসুল হক। এই বইয়ের ভাষা সংগীতের মতো, ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত কোষে, ইন্দ্রিয়ে আরাম দেয়। মনে থাকে না, কতক্ষণ এই আরামের সমুদ্রে ডুবে আছি।
বহুদিন পর কারো বই পড়তে পড়তে এক পলকের জন্যও উঠতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে, গাড়িতে, হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে ২০৭ পৃষ্ঠার একটা বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। পড়তে পড়তে ফেলে আসা দিনগুলিতে ফিরে গেছি। চোখের কোণে জল জমেছে, আর বুকে হাহাকার। কি করলেন মাহবুব ভাই?
আদর্শ থেকে বের হওয়া এই বই, বইমেলাতেও পাওয়া যাচ্ছে, দাম ৩৮০ টাকা! পড়তে পারেন।
ফেসবুক পোস্ট
No comments:
Post a Comment