তোমারে চিনি না আমি। ‘তুমি’ কে? আর ‘আমি’? তুমি আর আমি কি একজন? নিজের সম্পর্কে বলা? নিজেকে ‘অপর’ করে দিয়ে চেনার তারিকা মন্দ না। প্রশ্ন হতে পারে ‘আমি’র গোলকধাঁধা থেকে মানুষ বেরুতে পারে কি-না। অন্তত ব্যক্তি মানুষ সর্বস্ব হয়ে উঠার এ জগতে নিজেকে বিচার করার ক্ষেত্রে। নাকি, ‘আমি’ ও ‘তুমি’ কোনো এক পরম জগতে এক হয়ে বসত করে? তাকেই তালাশ করা হচ্ছে।
বেশ স্বাদু গদ্যে মাহবুব মোর্শেদ উপন্যাসটি লিখেছেন। টানা পড়া যায়। অস্বস্তিরও কারণ হতে পারে। আকর্ষণ ধরে রাখতে পারার গুণকে ভালো উপন্যাস বলে মানবেন তো সবাই?
উপন্যাসের মূল চরিত্র রানা রহমান নিজের কথা বলা গেছেন। নিজেকে নানা ঘটনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমেত খোলাসা করেছেন। আর রানাকে আমরা সনাক্ত করি বিবিধ চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলানোর ভেতর।
অন্য চরিত্রগুলো আসছে রানার চোখ দিয়ে। খুব বেশি ডিটেইলস আসে নাই সেই সব চরিত্রের— সঙ্গত কারণে। ফলত বিপুলা পৃথিবী রহস্য হয়ে হাজির থাকে। সে রহস্য খণ্ডিত হয় আবার হয়ও না। আবার সেই পৃথিবীতে জীবন রহস্য রানার সম্মুখে ফর্সা হতে থাকে। রানা যেন তা মানতে চায় না, আবার মেনে নিয়েও থাকে। শুধু ‘নিজের’ কাছে ফেরা হয় না আর! কী সেই ‘নিজে’?
জীবনকে যে অর্থের ভেতর প্রাচুর্যময় করে তুলতে হয়, তা অধরা থেকে যায়। রানা যদি অসংখ্য ব্যক্তি মানুষের একটা উদাহরণ হন। এজমালি অর্থে একটা অর্থহীনতার ভেতর আমরা খাবি খাই। সে যাতনা তারও।
রানার গল্পটা যুথবদ্ধতার মধ্যে নিজেরে খুঁজে ফেরা। ব্যক্তির অর্থপূর্ণতা অপরের সঙ্গে মিলেমিশে। বৃহত্তর জনমণ্ডলীর মাঝে নিজেরে আবিষ্কারে। জগতে অর্থপূর্ণভাবে অস্তিত্ববান হওয়া। যেটা দুই নর-নারীর প্রেমের মধ্য দিয়ে সম্ভব হতে পারে বলে মনে করে রানা। সে কী, কী হতে চায়, এ হতে চাওয়ায় পরিপূরক হিসেবে কেউ একজন আসবে— যারে বিদ্যুৎ চমকের মতো আবিস্কার করা যায় আলিঙ্গনে, চুম্বনে, যৌনতায়। এখানে স্থির হতে চেয়েছিল রানা। তার অর্থপূর্ণতার মানকাঠিও এই। মাঝে এসেছিল কবিতা ও রাজনীতি। তার সব-ই যেন টেনে নিয়ে গেছে এই লক্ষ্যে। অথবা নিজেকে চিনতে না পারার বেদনায় রক্তিম করে আরো।
যৌনতার বেশ আনাগোনা এ উপন্যাসে আছে। যৌনতা বিষয়ক নৈতিক অবস্থানকে টলিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবনাও আছে। উপন্যাসের কোনো চরিত্র টলিয়ে দেওয়ায় আপত্তিও করে না জোরালোভাবে। এটা নিয়া বইটার আলোচনায় কথা হচ্ছে অল্পবিস্তুর। কিন্তু শুধু যৌনতার আকর্ষণে উপন্যাসটা পড়ার কোনো ঘটনা আছে বলে মনে হয় না। বরং, ঘটনা রানাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে— সেদিকে টানবে। সেই জিজ্ঞাসা ও কৌতুহলকে উস্কে রাখাকে লেখকের মুন্সিয়ানা বলতে হয়।
গল্প বলার ঢংটি দারুণ আকর্ষণীয়। আর মূল চরিত্রের জিজ্ঞাসাগুলোকেও আপন করে নিতে পারে পাঠক। কোনো কোনো অংশে মনে হতে পারে নিজের গল্পটাই পড়ছেন তিনি। আর স্রেফ গল্প বলে যাওয়ার চেয়ে আরো কিছু ব্যাপার আছে ‘তোমারে চিনি না আমি’তে। উপলব্ধি, জিজ্ঞাসা, দর্শন ভাষা পায় সাবলীলভাবে। আছে নাড়া দেওয়ার মতো প্রকৃতির বর্ণনা। আছে সমসাময়িকতাকে যাপনের চিহ্ন।
আগেই বলেছিলাম রানা ভিন্ন অন্য চরিত্রগুলোর তেমন ব্যবচ্ছেদ নাই। এমনকি দুনিয়াদারিরও। যে অর্থে বিষয়গতভাবে ভাবা যায়। মানে লেখক সর্বেসর্বা হয়ে কুটাকুটি করেন যেভাবে। চলমান ঘটনার বিরতিতে মাঝে মাঝে কথপোকথনের কিছু দৃশ্য কল্পনার মাধ্যমে চরিত্রগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া করেন। এ বোঝাপড়া অপরের সাথে নিজেকে বোঝার, আবিষ্কারের। আবার সেই আপনাকেই অপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নিজের মধ্যে ধারণ না করেও বইতে হয়। তাই পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্নগুলোও মেলাতে হয় যেন অন্যের উত্তরের ভেতর। এটাই কি জীবনের প্রবাহমানতা? এর মাঝেই কি না পাওয়া উত্তর?
এ উপন্যাসের ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার সরদার। রহস্যময় এক ব্যক্তি। উপন্যাসটা যখন একঘেয়ে হয়ে যাবে যাবে পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল তখন সরদার হাজির হয়ে বাঁক বদল করে দেন। এমন ধাক্কা আমাদের জীবনে কোনো না কোনোভাবে ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় হয়তো। সরদারের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি উপন্যাসের চরিত্রের পাশাপাশি পাঠককেও ভাববার সুযোগ করে দেয়। এ যেন রানার আত্মার ভেতর থেকে উচ্চারণ। কে তাকে ছুঁতে পারে যথা সময়ে? হয়তো ‘তোমারে চিনি না আমি’ সরদারকে উদ্দেশ্য করে বলা। যা আবার প্রতিধ্বনি হয়ে রানার দিকেই ফিরে আসে। যেখাবে ‘আমি’ আর ‘তুমি’ বিলীন হয়ে যায়।
সরদারের প্রণোদনায় কবিত্ব দারুণভাবে উপভোগ করতে পারেন রানা। হঠাৎ ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াকেও উপভোগ করেন। জগত ও জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখার কোনো আকাঙ্খা থাকে না তার। এর মধ্য দিয়ে সচরাচর ‘প্রগতিশীল’ বলে যে রাজনীতি ট্যাবু হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তার ক্রিটিক আছে। লক্ষ্যহীন কবিত্বেরও। কৌতুহলজনকভাবে ইসলামি ছাত্র শিবির প্রসঙ্গ খানিকটা আছে— আরো জানতেও ইচ্ছে করে তাদের প্রসঙ্গে, যারা আমাদের সাহিত্যে অচ্ছুত। তেমনি বামপন্থী প্রসঙ্গগুলোও। সমসাময়িক চিত্রগুলা আমাদের উপন্যাসে উঠে আসা দরকার। অল্প বিস্তুর যা আছে- তার জন্য সাধুবাদ।
উপন্যাসটা পড়তে পড়তে পাঠকের আত্মোপলব্ধি হতে পারে। যেহেতু তার সময়টাকেই উদযাপন করা হচ্ছে। মনে হতে পারে, বিষয়টা রানার মুর্হূতিক আকাঙ্খা বা বোঝাপড়া নয়— বরং জীবনকে বৃহত্তর অর্থে দেখতে না পারার সংকট। এ সংকট বা স্থবিরতা সমকালীন বাংলাদেশে আমাদেরও নয়?
নিজেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা আকারে জগতকে পেছনে রাখার সংকট বিদ্যমান। যে কারণে তার কবিত্ব বা রাজনীতি বড় কোনো স্বপ্ন তৈরি করে না। রানা যেন আত্মাহীনভাবে বসত করেন। সেই সংকট মাহবুব মোর্শেদ কতটা আঁকতে পেরেছেন ভাবার বিষয় বটেও! আরো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখার বাসনাও তৈরি করে। কথা বলতে ইচ্ছে করে বাকি চরিত্রগুলো ধরে ধরে।
রানার বেড়ে ওঠা, বিশ্ববিদ্যালয়, তার মাঝে বুনে দেওয়া আকাঙ্খা, সেখান থেকে বের হতে চাওয়া বা না চাওয়া, নিস্ক্রিয় যাপনের ভেতর নিজেকে ইহলৌকিকতার মধ্যে ফয়সালার একটা প্রয়াস হিসেবে ‘তোমারে চিনি না আমি’ অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব ফুলে-ফলে বেড়ে উঠুক। আমার এই চাওয়া চিনতে পেরেছি পঠন শেষে। প্রশংসা করি পাঠকের!
তোমারে চিনি না আমি । মাহবুব মোর্শেদ । প্রকাশক আদর্শ । ফেব্রুয়ারি ২০১৮ । মূল্য ৩৮০ টাকা
ব্লগ
যুগান্তর সাময়িকী
No comments:
Post a Comment